স্মৃতিযাপনে শেকড়ের গল্পের দ্বিতীয় দিন
বাংলাদেশিপনায় মাততে, বঙ্গাব্দ ১৪৩২-এর শেষটা আমরা ‘গুণবতী’ পরিবার উদযাপন করেছিলাম নতুন শক্তি নিয়ে—পরিবারটিকে আরও বড় করে তোলার প্রত্যয়ে। ১১, ১২ ও ১৩ এপ্রিল ২০২৫—এই তিনদিন ধানমন্ডির Alliance Française de Dhaka ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হয় ‘গুণবতী’র প্রথম একক প্রদর্শনী, ‘শেকড়ের গল্প – Celebrating Bangladeshiness’। আমাদের এই যাত্রায় BRAC IED ছিল Sustainable Partner, এবং BYEI ছিল Strategic Partner হিসেবে। তাঁদের আন্তরিক সহযোগিতায় এই আয়োজন প্রাণ পেয়েছে—সেজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। তিনদিনের এই আয়োজনে দ্বিতীয় দিনটি, অর্থাৎ ১২ই এপ্রিল, হয়ে উঠেছিল এক বিশেষ মুহূর্ত—‘গুণ বিনিময়ের দিন’। এইদিনই আমাদের কারিগরদের হাতে-হাতে শেখানোর উদ্যোগের মধ্য দিয়ে গুণবতীর স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখেছিলেন দর্শনার্থীরা। শেখা ও জানার মুহূর্তগুলো দিনের শুরু হয় দুই গুণী কারিগর, সুনিতা রানী এবং অসিম বিশ্বাস এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিয়ে। তাঁরা বলেন তাঁদের বুননের ঐতিহ্য, পারিবারিক ধারা, এবং নতুন প্রজন্মের জন্য তা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টার কথা। তাঁদের হাত ধরে ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণকারীরা শিখেছেন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী তিন ধরনের বুনন—দোধারা, তেধারা ও এক পোখর। সুনিতা দিদি বুঝিয়ে দেন কীভাবে বেতি দিয়ে এক একটি ধাপে ধাপে বুনন গড়ে ওঠে। শেখার সুবিধার্থে ব্যাবহার করা হয় দুইটা ভিন্ন রঙের বেতি। এরপর অসিম দাদা দেখান চাকানোর কাজটা। এটাই তাঁদের পারিবারিক শ্রমবন্টন; পুরুষদের কাজ শক্তির জায়গায়, আর মহিলারা করেন সূক্ষ্মতাঁর কাজ। পরিবারের ভেতরেই এই কাজের স্বাভাবিক বিভাজন যেন হয়ে উঠেছে এক অপূর্ব টিমওয়ার্ক। বৃষ্টি, ভেজা রাস্তাঘাট আর যানজট পেরিয়ে যারা এসেছিলেন, তাদের আগ্রহ আর উদ্যম আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। একেকজন যখন দিনশেষে নিজের হাতে তৈরি বুনন নিয়ে হাসিমুখে বের হন—সেই হাসি আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আলোচনায় শিল্প, সমাজ ও আত্মপরিচয় ওয়ার্কশপ শেষে শুরু হয় বিকেলের প্যানেল আলোচনা। সূচনা বক্তব্যে গুণবতীর কর্ণধার মালবিকা দিপান্বিতা রায় তুলে ধরেন গুণবতীর ভাবনা, যাত্রা ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন। এরপর গবেষক সংলাপ বিশ্বাস তুলে ধরেন অক্সফ্যামের অর্থায়নে সদ্য সম্পন্ন হওয়া গবেষণার চিত্র—যেখানে উঠে আসে গুণবতীর কাজের পেছনের নানান বাস্তবতা, মানুষের গল্প, ও স্থানীয় জ্ঞানভিত্তিক সংকট ও সম্ভাবনার দিক। এর ভিত্তিতেই শুরু হয় মূল পর্ব—প্যানেল আলোচনা, যার সঞ্চালনায় ছিলেন পরিবেশ ও সামাজিক উদ্যোক্তা, সুচিন্তকথক সৈয়দ মুনতাসির রিদওয়ান ভাই। আলোচনায় অংশ নেন: তাঁদের কথা, অভিজ্ঞতা, অনুভব আর অনুপ্রেরণার মেলবন্ধনে এক বিকেল হয়ে ওঠে স্মৃতি চারণ এবং ভাবনার খোরাক। আমরা একসাথে কাজ, স্মৃতি আর আকাঙ্ক্ষার গল্পে ডুব দিয়েছিলাম—প্রত্যেক বক্তাই কথা বলেছেন তাঁদের নিজের অভিজ্ঞতা আর প্যাশনের যায়গা থেকে। সেই সন্ধ্যার আন্তরিকতা আর আবেগ এখনো আমাদের পথচলাকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। শেকড়ের গল্প কেবল এক প্রদর্শনী নয়, আমাদের নিজের ভেতরে ফিরে তাকানোর একটা সুযোগ—আমাদের ঐতিহ্য, সমাজ আর আত্মপরিচয়কে নতুন করে চেনার, বোঝার এবং বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস।আমরা কৃতজ্ঞ BRAC IED, BYEI, Alliance Française de Dhaka এবং প্রতিটি অংশগ্রহণকারীর প্রতি—যারা শুধু পাশে ছিলেন না, বরং এই গল্পটাকে আপন করে নিয়েছেন। সামনে আরও অনেক গল্প আসছে, আরও অনেক মুহূর্ত—আপনারা পাশে থাকুন, হাত ধরে এগিয়ে চলি।